Friday, July 26, 2013

এডওয়ার্ড সাঈদ আর একবাল আহমাদের প্রাসঙ্গিকতা

   সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার প্রভুর যত ইচ্ছা গ্রন্থের প্রথম রচনাটিতে সাঈদকে বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী হিসেবে উল্লেখ করেছেন।[1] গ্রামশির বহুল ব্যবহৃত ‘অরগানিক বুদ্ধিজীবীর’ ধারণাটি চৌধুরী অন্যান্য সমালোচকের মতই সাঈদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন কারণ পাচ্যবাদের মত একটি মৌলিক ধারণার জন্ম দেবার পাশাপাশি সাঈদ তার পূর্বপুরুষের জন্মস্থান প্যালেস্টাইনের মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন। সাঈদের মহত্ত্বের জায়গা আসলে এইযে পশ্চিমের ডাকসাইটে বিশ্ববিদ্যালয়ের (কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক হয়েও তিনি ভুলে যাননি তার অতীত, তার জাতিগত ইতিহাস ও সর্বোপরি তার জীবনে ঔপনিবেশিকতার সর্বগ্রাসী ভূমিকার কথা। সাঈদ তার লেখনীতে, তার বক্তিতায় ও তার পাঠদানে ক্রমাগত প্রমাণ দিয়ে গেছেন আধুনা বিশ্ব-বাবস্থাও কিভাবে ঔপনিবেশিকতার ঘেরাটোপে বন্দী।

   সাঈদের অকৃত্তিম বন্ধু ছিলেন একবাল আহমাদ এবং সাঈদের মতই তিনি অধ্যাপনা ও সম্মুখ সমরের রাজনীতি দুটোই এক সাথে চালিয়ে গেছেন। Youssef Yacoubi Edward Said, Eqbal Ahmad, and Salman Rushdie: Resisting the Ambivalence of Postcolonial Theoryথেকে আমরা জানতে পারি আহমাদ প্যালেসটাইন লিবারেশন অরগানাইজেশনের (পিএলও) উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং সংগঠনটিকে যুগপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে তাগাদা দিয়েছেনঃ “By insisting on the complex connections that Israel has with US economic interests and hegemony in the Middle East, Ahmad was responding to a PLO at that stage fixated on the absolutism of armed struggle. He went further by formulating alternative strategies that would strengthen the idea of resistance to the Zionist scheme to annihilate Palestinian collective memory” (ইয়াকুবি ১৯৬).  আহমাদ পিএলওকে অব্যাহত সামরিক অভিযানের বদলে ইহুদী বসতি স্থাপন বন্ধের উপর জোর দিতে বলেছেন। তেমনই জনসচেতনতা বাড়ানোর উপায় খুঁজে বের করতে বলেছেন। বলা বাহুল্য আহমাদ সাঈদের সুহৃদে পরিণত হন। রাজনীতি বিষয়ে আহমাদকে গুরু মানতেন সাঈদঃ “Said himself depended on Ahmad’s practical propositions, and on his ability to deliver precise and persuasive strategies. He called him simply ‘my guru in political matters’” (১৯৬)  
             
   আহমাদ ও সাঈদের মিল কেবল রাজনৈতিক বিশ্বাসেই সীমাবদ্ধ ছিল না। দুজনেই বহু দিক থেকেই অভিন্ন ছিলেন। তাদের দেশান্তরিত হতে হয়েছিল খুব অল্প বয়েসেই। সাঈদের পাড়ি জমান মিশরে, আর আহমাদের পরিবার সাতচল্লিশের দেশ বিভাগের পর বিহার থেকে পাকিস্তানে চলে যায়। উভয়েই পরবাসী অথবা exiled যা তাদের চিন্তা চেতনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। Reflections on Exile গ্রন্থে সাঈদ বলেন, “Exile is strangely compelling to think about but terrible to experience. It is the unhealable rift forced between a human being and a native place, between the self and its true home: its essential sadness can never be surmounted (সাঈদ ১৭৩). পরবাসীর জীবন সাঈদের কাছে এক দুঃসহ বেদনা (‘essential sadness’)তার মতে নির্বাসনের জীবন বাক্তি মানুষকে তার জন্মভুমি থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন করে তাকে এক ভয়ঙ্কর সত্যের মুখোমুখি দাড় করায়। তাইতো সাঈদ তার বহু গ্রন্থে, বিশেষত Reflections on Exile গ্রন্থটিতে, নির্বাসনকে রুপকল্প হিসেবে ধরে নির্বাসনের গতি-প্রকৃতি ব্যাবচ্ছেদে ব্রত হন। তাই সাঈদ নিজভূমে পরবাসী প্যালেস্টাইনের জনগণেরও প্রতি স্বভাবতই সহমর্মী ছিলেন এবং তাদের মুক্তি চিন্তায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেন।

   একবাল আহমাদও পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের অসাড়তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তার লড়াইটি কেবল মাত্র পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও নব্য উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ছিল না, তাকে লড়তে হয়েছে উপমহাদেশের সাতচল্লিশ-পরবর্তী নষ্ট রাজনীতির বিরুদ্ধে। বিহার থেকে পাকিস্তানে দেশান্তরী হয়ে আহমাদের গায়ে আটকে গিয়েছিল ‘মোহাজির’ তকমাটি, মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান যে কেবল সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈরি ছিল তাই নয়, মূলধারা থেকে বিছিন্ন হয়ে পরা বিহারী জনগোষ্ঠী পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈষম্যের শিকার হয়েছে। বাঙ্গালীদের মত আহমাদও উপলব্ধি করলেন সমস্যার গোঁড়ায় রয়েছে পাকিস্তানের সামরিক তন্ত্র ও মোল্লা তন্ত্র। আরও আবিষ্কার করলেন এরাই হল উপমহাদেশে নব্য উপনিবেশবাদের দোসর। কলম ধরলেন তিনি এদের বিরুদ্ধে, তেমনি শাণিত করলেন নিজের রাজনৈতিক চেতনাকে।

   Cosmopolitan চেতনার অধিকারী আহমাদ উপমহাদেশের রাজনীতির সমস্যা চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন কারণ তিনি উপনিবেশবাদের উপসর্গ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। উপনিশবাদের divide and rule নীতি উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান মধ্যবিত্তকে মুখোমুখী দাড় করিয়ে দিয়েছিল যার চূড়ান্ত পরিণতি হল ১৯৪৭ সালের দেশভাগ ও ভয়াবহ দাঙ্গা। দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায় ১৯৪৭ পরবর্তী ভারত ও পাকিস্তানকে আরও সাম্প্রদায়িক করে তুলবে, এমন অমূলক ধারণার বিরোধী ছিলেন আহমাদ। তিনি বুঝেছিলেন সাম্প্রদায়িকতার সূচনা উপনিবেশ আমলে, আর তার রূপান্তর ঘটবে নব্য উপনিশবাদী দেশীয় (native) দোসরদের হাতে। তাইতো তিনি বার বার আঘাত করেছেন উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলোকে।

   “South Asia: We meet again” তার একটি বাঙ্গাত্তক রচনা যেখানে তিনি হিন্দু ও মুসলমান মৌলবাদীকে মুখোমুখি দাড় করিয়ে দেন। মৌলবাদীদের ঘাটিতে পরিণত উপমহাদেশ একবালের রচনায় “South Asian Hall of Shame যেখানে কেবলমাত্র মৌলবাদী আর তাদের সঙ্গপাঙ্গদের আস্ফালন পরিলক্ষিত হয় (আহমাদ ৮৩)আহমাদের হিন্দু মৌলবাদী ঘোষণা দেয়ঃ My followers are the true sons of Indian soil. Most of them are hungry, homeless, illiterate, and angry over this minor deprivation. Their anger is lethal like gunpowder, and deserved to be channeled in the right direction. I have a talent and commitment to channeling it against the Dalit, Sikhs, and above all, the Muslims.    That is why rich hindu families,  including Dalmia Ji and members of the Birla family which  once supported that false Mahatma called Gandhi, now support us with money” (৮৩). উক্তিটি থেকে পাঠক মাত্রই বুঝতে পারে দরিদ্র জনগণের ধর্ম্যানুভুতিকে পুঁজি করে এবং হিন্দু বেনিয়াদের সহায়তায় কিভাবে হিন্দু মৌলবাদীরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের ষড়যন্ত্র করছে।  

   রাবেলিসিয় (Rabelaisian)  ভঙ্গিমায় আহমাদ হিন্দুত্ববাদীর মুখোশ উন্মোচন করে দেনঃ “... there is the Taj Mahal, which, we have proof, belong to a Hindu raja ... These Muslims! We also have powerful friends such as the Zionist colleague who published an article about the Taj Mahal in the New York Times. How can the Muslims fight both us and the Zionists?” (৮৪). সাঈদের সহচর আহমাদ এইখানে ফিলিস্তিনি ও উপমহাদেশের অভিন্ন শত্রু হিসেবে জায়ন-বাদীদের উপস্থিত করেন। তিনি “General Zia Sahib Marhoomএর সাগরেদ মুসলিম মৌলবাদীকেও তীব্র আক্রমণ করেনঃ Our following is small, which is one reason why we do not do too well in elections unless they are organized properly by an Islam Pasand dictator like Zia Marhoom. But our organization is excellent and it proves itself in times when there is crisis and public emotions are high” (৮৫-৮৬). হিন্দু রাষ্ট্র ভারতের ষড়যন্ত্র রক্ষার নামে মুসলিম মৌলবাদীরা কেবল সামরিক শাসকদের, যে কিনা আবার সাম্রাজ্যবাদের পদলেহক, অনুগ্রহ লাভে বাস্ত।আর ধর্মভীরু জনগণের অনুভূতিকে পুঁজি করে নিজের ফ্যাসিবাদী এজেনডা  বাস্তবায়নে জামাত, হিযব-উত-তাহরির প্রমুখ মৌলবাদীদলের জুড়ি মেলা ভার।  দীপ্তচিন্তে একবাল বলেছেন ইসলাম হল নিপীড়িতের ধর্ম, তাতে নিপীড়কের স্থান নেই। তিনি মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে সম্পূর্ণ খারিজ করে দিয়েছেনঃ “The recent rise of fundamentalist, neototalitarian Muslim movements is an aberration, not a norm in Muslim history(আহমাদ “ইসলাম এন্ড পলিটিক্স” ১৬৩)।                                                               
   সাঈদও তার লেখনীতে সাম্প্রদায়িকতাকে আঘাত করেছেন, তবে সেটি ধর্মভিত্তিক নয়, বরং বর্ণবাদ উৎসারিত সাম্প্রদায়িকতা। সাঈদ জায়নবাদকে প্রশ্ন করেছেন, তার নৈতিক ভিত্তিমূলে আঘাত করেছেন। তিনি তার সৃষ্টিকর্মে বার বার দেখিয়েছেন জায়নবাদের অশুভ পরিণতি যা কিনা ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে বাস্তুভিটা ছাড়া করতে ক্রমাগত ক্রিয়াশীল। আহমাদ যেমন উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িকতার সাথে উপনিবেশবাদের সম্পর্ক খুঁজে পান, সাঈদ দেখান, জায়নবাদ ও উপনিবেশবাদ পরিপূরক।

   জায়নবাদ ও উপনিবেশবাদ পরিপূরক বলেই ইসরায়েলী রাষ্ট্রযন্ত্র ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার হরণে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করেছে যেমনটা করেছিল ইংরেজ উপনিবেশবাদিরা পৃথিবীর না প্রান্তে, বহু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে কেবল শোষণ নয়, নিঃশেষ করার অভিপ্রায় নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা। রচনাটিতে সাঈদ বলেন, ইহুদীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ইসরাইল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বদলে একটি নতুন সাম্রাজ্যের সৃষ্টি করেছে যা কিনা বর্ণবাদী ও ফ্যাসিবাদী, কারণ ফিলিস্তিনি জনগণকে ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ করে আর যাই হোক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আর যে প্রকল্পটি এই অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্মদাতা, অর্থাৎ জায়নবাদ, তাকে তিনি বার বার প্রশ্ন করেছেন, অন্তর্গত বৈপরীত্যগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। তাই তো তার ভাগ্যে জুটেছে বহু তিরস্কার, বিশেষায়িত আক্রমণ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদিবাদী, জায়নবাদী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে, যারা “তাকে ‘প্রফেসর অব টেরর’ বলে ডাকা শুরু করে” (প্রথম আলো, ৩ অক্টোবর, ২০০৩)[2]

   একবাল আহমাদ ও এডওয়ার্ড সাঈদ নিজেদের একাডেমীর সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি। পশ্চিমের ডাকসাইটে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হিসেবে তারা বেশ নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু তাদের লক্ষ্য ছিল গনমানুষ, বিশেষ করে বাস্তুচ্যুত, নির্বাসিত মানুষের কান্না তাদের প্রবল ভাবে নাড়া দিয়েছিল। তাইত অরাজনৈতিক, বেনিয়া গোষ্ঠীর তাঁবেদারির করাল গ্রাস থেকে বেড়িয়ে মানব মুক্তির সন্ধানে ঘুরে ফিরেছেন সাঈদ ও আহমাদ দুজনেই।

   তাইতো সাঈদ “Secular Criticism প্রবন্ধে জুলিয়েন বেন্দার উদ্ধৃতি দিয়ে জানাচ্ছেন, “For the intellectual class, expertise has usually been a service rendered, and sold, to the central authority of society” (বায়েওমি ও রুবিন ২২০).  বিশ্বব্যাপী ঘটে চলা অন্যায়, অবিচার ও রাষ্ট্রের জিঘাংসার স্বীকার হওয়া মানুষকে ভুলে যাওয়াই যেন একাডেমিকের নিয়তি, অত্যন্ত পরিহাস ও পরিতাপের সাথে সাঈদ ব্যাপারটি উল্লেখ করেনঃ “We tell our students and our general constituency that we defend the classics, the virtues of a liberal education, and the precious pleasures of literature even as we show ourselves to be silent (even incompetent) about the historical and social world in which all these things take place ” (২২০)ছাত্র আর গুণমুগ্ধদের সামনে সাহিত্য আর সাহিত্যিকের মহত্ত্ব-গাঁথা বর্ণনায় তিনি হাঁপিয়ে উঠেন, কারন তিনি জানেন ইতিহাস ও সমাজ বাস্তবতা সাহিত্যের ও লিবারেল শিক্ষা বাবস্থার বিপরীত প্রকল্প তৈরি করেছে, যা মানবতা বিরোধী, শিশ্নধর ও বৈষম্যমূলক।       হতাশা ঝেড়ে ফেলে সাঈদ হয়ে উঠেন প্রতিবাদী, সংকল্পবদ্ধ হয়ে উঠেন শোষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আসন্ন লড়াইয়ের জন্য, নিজের একাডেমিক অবস্থানকে নতুন আঙ্গিকে সাজাতেঃ  “… it is no accident that the emergence of so narrowly defined a philosophy of pure textuality and critical non-interference has coincided with the ascendency of Reganism … increased militarism and defense spending, and a massive turn to the right, on matters touching the economy, social services and organized labour (২২২) সাঈদ বুঝতে পেরেছেন শিক্ষকের (যারা ঐতিহাসিকভাবে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা পালন করে এসেছেন)নীরবতা শক্তিশালি করেছে রাষ্ট্রকে, সাম্রাজ্যকে ও সর্বোপরি প্রতিক্রিয়াশীলটাকে। সামরিক বাহিনীর নগ্নশক্তি বৃদ্ধিও সাঈদকে পীড়িত করেছে। সর্বদাই তিনি কাছে পেয়েছেন বন্ধু একবাল আহমাদকে যিনিও কিনা একাডেমিক গণ্ডীর বাইরে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, জনমত গঠনে সচেষ্ট হয়েছেন।        

   সাঈদ ও আহমাদ বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। আজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নতুন নতুন আঙ্গিকে নিজেকে উপস্থাপন করছে। নজরদারির নিত্যনতুন কলা-কৌশল গণতন্ত্রকে ও মানুষের স্বাধীনতাকে নগ্নভাবে বন্দী করে ফেলছে। বেন্থামের পানপটিকন আর ফুকো বর্ণিত জ্ঞান ও ক্ষমতার নেক্সাস গণমানুষকে নতুন করে আরও প্রযুক্তি উৎকর্ষ-কায়দায় কয়েদ করে ফেলছে। সাঈদের অন্তর্ধান ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনকে স্তিমিত করেছে, বহুধা বিভক্ত ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনকে আরও বাধাগ্রস্থ করছে জায়নবাদের সমর্থক বিশ্ব মোড়লেরা। উপমহাদেশের সামরিকায়নের বিস্তার ঘটেছে, মৌলবাদী শক্তি সমাজের সর্বস্তরে জাঁকিয়ে বসেছে। আজ ফিলিস্তিনের বড়ই প্রয়োজন একজন এডওয়ার্ড সাঈদের আর ভারতীয় উপমহাদেশে একজন একবাল আহমাদের জন্ম নেয়া অতি জরুরী।

Works Cited:

Ahmad, Eqbal.  “South Asia: We meet again” in Race Class 1993 34:83. Downloaded from rac.sagepub.com at UNIV OF MAINE ORONO on December 28, 2012.  

---. “Islam and Politics” in Bengelsdorf, Cerullo and Chandrani (eds) The Selected Writings of Eqbal Ahmad. New York: Columbia University Press, 2006. Print. 

Bayoumi, Moustafa. and Andrew Rubin (eds) The Edward Said Reader. New York: Vintage Books, 2000. Print.
  
Said, Edward.  Reflections on Exile and Other Essays, Delhi: Penguin Books India (P) Ltd. 2001. Print.

Yacoubi, Youssef. “Edward Said, Eqbal Ahmad, and Salman Rushdie: Resisting the Ambivalence of Postcolonial Theory”. Alif: Journal of Comparative Poetics, No. 25, Edward Said and Critical Decolonization (2005), pp. 193-218.  Retrieved  July 1, 2010. from http://www.jstor.org/stable/4047457







[1] সিরাজুল ইসলাম চৌধুরি. প্রভুর যত ইচ্ছা. ঢাকা:অন্য প্রকাশ, ২০০৫.     
[2] ইসলাম, মনজুরুল সৈয়দ. “লেখা যখন সক্রিয়তা”, প্রথম আলো, ঢাকা, অক্টোবর, ২০০৩.

Saturday, May 11, 2013

জাহিদ আকতারের “আপনাদের বলছি” ও “লাশ”ঃ অস্থির সময়ের প্রতিচ্ছবি


জাহিদ আকতারের সাথে পরিচয় বছর দুয়েকের ওনাকে কমিটেড একাডেমিক  প্রবলভাবে রাজনীতি সচেতন মানুষ হিসেবেই জানতাম। তিনি যে কবিতাও লেখেন, অত্যন্ত শক্ত ধাঁচের কবিতা,  জানতাম না। তিনি লেখেন, লিখছেন, ফেসবুকে আমাদের মাঝে অকাতরে বিলিয়ে বেড়াচ্ছেন।গণমানুষের প্রতি শাসক শ্রেণী তাদের চ্যালা চামুণ্ডাদের অবিচারের প্রতি তীব্র অনাস্থা জ্ঞাপন করে লেখা কবিতাগুলো আমাদের চারপাশে খেটে খাওয়া মানুষের উপর উন্নয়নকামী সমাজের ভায়োলেন্সের কথা মনে করিয়ে দেয়।  কবিদের প্লাতো তার উন্নয়নের রূপকল্প শহর-রাষ্ট্র থেকে বিতারনের প্রস্তাব করেছিলেন বহু বছর আগে, সত্যি কবিরাশাইনিং গ্রীক-শহরঅথবাশাইনিং ঢাকাধারণাগুলো কে পরিপূর্ণ রূপ দেয়ার পথে বড় বাঁধা ক্রীতদাস শ্রমিক, উভয়েই উন্নয়নমুখী অর্থনীতির অত্যাবশ্যকীয় উপাদান, কিন্তু মোটেও উন্নয়ন অংশীদার নয়। কবিরা এই রাষ্ট্রীয় প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, প্লাতোর কাছে কবিরা তাই অগ্রহণযোগ্য, উচ্ছিষ্ট ২১ শতকের ঢাকায় উন্নয়ন অর্থনীতির চাকা বেশ জোরসে সচল তাই জাহিদ আকতারের কবিতা রাষ্ট্রের কর্নাধারদের কাছে উপাঙ্গতেয়, বিরক্তি উদ্রেককারীও বটে কারণ এতে শ্রমিকের কথা থাকে, বখতিয়ার আহমেদের ভাষায় বলতে গেলেকাঠামোগত গণহত্যারবিরুদ্ধে দ্রোহ থাকে (দোহাইঃ   http://www.unmochon.com/2012/11/25/39822.html#.UY3do7XP3rw) 

ফেসবুকে প্রকাশিত কবিতাগুলোতে কপিরাইটের বিশেষ ঝামেলা নেই বিধায় অনেকটা সাহস করেই কবিতাগুলো ব্যাবচ্ছেদ করে ফেললাম, কারণ মনে হল জরুরী, অতি জরুরী, না বলা কথাগুলো আকতার তার কবিতায় অকপটে বলে ফেলেছেন। ফেসবুকের বড় ভোক্তা উচ্চ মধ্যবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণির কথাগুলো জানা বেশ জরুরী, কারণ তাতে অল্প হলেও ওপরের-তলায় মারিও-স্টাইলের লাথি লাগার সুযোগ আছে। লাথি মারতেই হবে, নাইলে সুন্দরবন বাঁচবে না, বাঁচবে না শাল-গজারের বনভূমি, আরও বাঁচবে না এদেশের মানুষ যাদের জিম্মি করে চালানো হচ্ছে উন্নয়নের ষ্টীম-রোলার।   
               
আপনাদের বলছিকবিতাটির কথাই ধরা যাক আকতার তুলে ধরেন উন্নয়ন প্রত্যাশী বেনিয়াদের দম্ভ, তাদের অশ্লীল দাবীর খতিয়ানঃ

           “আপনারা আবার সেই পুরনো ক্লিশে কিছু কথা বলছিলেন
            অনুযোগের সুরে বলছিলেন বউ ছল শাক-কচু খাইবার পায় না।'
           একবিংশ শতাব্দীতে এসে আপনারা আবার তেতাল্লিশের কথা বলছিলেন
           চুয়াত্তরের কথা বলছিলেন
           আপনারা আবার সেই পুরনো কথা বলছিলেন
           আপনাদের লজ্জা করা উচিত"   

এইআপনারাহল মেহনতি মানুষ, যাদের সামান্য দাবী (“আপনারা কষ্টের কথা বলছিলেন/না খেয়ে থাকার কথা বলছিলেন”) রাষ্ট্র ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেঃ

                 “আপনাদের বিশ্বাসকে, আপনাদের দর্শনকে, আপনাদের আশাবাদকে
                  আমরা নাড়িভুড়িসমেত প্রত্যাখান করি"

রাষ্ট্রের এইনারিভুরিসমেত প্রত্যাখ্যানসর্বক্ষেত্রে দৃশ্যমান বিত্তবান, বেনিয়া, আধিপত্যবাদী শ্রেণিটি কোন দাবী, বিত্ত আহরণের পথে কোন নড়চড়কে আস্কারা দেয় না, ক্ষমতা প্রদর্শন করে প্রত্যাখ্যান করে গরীবের ন্যায্য পাওনা, তাদের এইনারিভুরিসমেতডিনাইয়াল রূপকার্থে গরিবের ভূখা নাড়িভুঁড়ির চিহ্ন বহন করে।  কবিতাটিতেকাঠামোগত গণহত্যারএকটি আলামত আমরা পাই, কবিতার বয়ানকারী শাসকশ্রেণীর প্রতিনিধিটি হঠাৎ করে ভিতরের ঘৃণাটিনাড়িভুঁড়িসমেতউগড়ে দেয়ঃ   

                 “কত মাস, কত বছর, কত সহস্রাব্দ ভালো থাকলে 
                      তাকে আপনারা ভালো থাকা বলবেন?
                      আর কতবার এ্যাকই কথা বলে আপনারা 
                      মরে যাবেন, পচে যাবেন, গলে যাবেন, 
                      তবু নির্লজ্জের মত আবার জন্মাবেন? 

আমাদের সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের চিত্রকল্প আকতারের এই লাইনগুলোতে পাওয়া যায় গার্মেন্টস ধ্বসে ১০০০ মৃত্যুর পর কয়েকদিন কুমিরের অশ্রুপাত চলে, তারপরই শুরু হয় শিল্প (পক্ষান্তরে মৃত্যুকূপ) বাঁচানোর তথ্য উপাত্ত ভিত্তিক বয়ান। বয়ানের ভাষাবিজ্ঞানঅর্থনীতিরমাপকাঠি মেনে চলে, সেখানে থাকে মৃদু হুমকি, ‘ব্যাটা চাষা-ভূষার দল, কাজ না করলে খাবি ক্যামনেকিন্তু সামান্যতম প্রতিবাদ হলেই শুরু হয়নারিভুরিশমেতআক্রমণ, উন্নয়ন-অর্থনীতির ভাষা বুঝিস না, ব্যাটা অর্ধ-শিক্ষিত, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স, নিদেনপক্ষে দেশের আই.বি./ এন এস ইউ থেকে বাবসা-প্রশাসনে একটা ডিগ্রী নিয়ে আয়, তারপর কাব্যগিরি ফলাস। আকতার সরাসরি কথাগুলো বলেন না, কিন্তু পাঠকের বুজতে অসুবিধা হয় না, “আপনাদের বলছি কবিতার বয়ানকারী চিবিয়ে- চিবিয়ে এই কথাটি বলেন অথবা বলতে চান তবে আগে ভাগেসিরাজগঞ্জের সিমলা গ্রামের বাস কন্ডাক্টর আবু তালেব,/ খুলনার পাইকগাছার দিনমজুর রণজিৎ সাহা,/ সাভারের গার্মেন্টস শ্রমিক মরিয়ম বেগমকে পেয়ে তাদের উপরই সব রাগ ঝাড়েন        
                   
লাশ কবিতাটি বর্তমান সময়ে চলে আসা গণহত্যা প্রতি-গণহত্যা ডিসকোর্সের গালে একটি চপেটাঘাত। কবিতাটিতে প্রাসঙ্গিক ভাবেই কিছু প্রশ্নের উত্তর চাওয়া হয়েছে, অনেকটা সরল, অকপটভাবে। মনে হতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকার লেখক কুদজিয়ার সেই বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী চরিত্রটি (মাইকেল কে) যেন আকতারের কবিতায় প্রবলভাবে উপস্থিত হয়েছে, প্রশ্নবাণে আমাদের বিবেককে নাজেহাল করছে। প্রশ্নগুলো আবার অবান্তরও, কারণ উত্তর আমাদের জানা আছে। তবুও প্রশ্নগুলো কেমন যেন উপেক্ষার নয়, গলার কাঁটার মত বেঁধে থাকে পাঠকের বিবেকের দেয়ালে। আকতার প্রশ্ন তোলেনঃ

          “রাস্তায় কেউ কোনোদিন প্রধান সেনাপতির লাশ দ্যাখেনি
          যেমন দ্যাখেনি কেউ কোনোদিন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের লাশ
          রাস্তায় কেউ কোনোদিন মাল্টিন্যাশনালের প্রধান নির্বাহীর লাশ দ্যাখেনি 
          যেমন দ্যাখেনি কেউ কোনোদিন কোট টাই পরা শিল্পপতির কেতাদুরস্ত লাশ। 
          কেউ কোনোদিন দ্যাখেনি গায়ে পারফিউম মাখা মন্ত্রীর প্রটোকলের লাশ ...
          রাস্তায় কেউ কোনোদিন আমৃত্যু সংগ্রাম চালানোর আহ্বান জানানো 
          জননেতার লাশ দ্যাখেনি, যেমন দ্যাখেনি কেউ কোনোদিন একুশে পদক 
          পাওয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারন করা ঔপন্যাসিকের লাশ। রাস্তায় কেউ 
          কোনোদিন ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপকের হিসেবি লাশ দ্যাখেনি যেমন দ্যাখেনি 
          কেউ কোনোদিন বুদ্ধিজীবীর চশমা পরা বিদগ্ধ লাশ। কেউ কোনোদিন 
          দ্যাখেনি সুশীল সমাজের টেরিকাটা চুলের সুবিন্যস্ত লাশ পড়ে আছে রাস্তায়"

আকতারের কবিতায় প্রধান সেনাপতি, ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক, মাল্টিন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারন করা ঔপন্যাসিক, বুদ্ধিজীবী একাকার হয়ে যান সমাজেকো-অপশনব্যাধি যে কত মারাত্মক আকার ধারণ করেছে তার প্রকৃষ্ট উদাহারন হয়ে থাকে কবিতাটি একে অন্যকে শোষণ শাসনে সহায়তাকারী গোষ্ঠীগুলো কখনোই লাশ হয়না, লাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাইতোঅবিরাম গুলি বর্ষণের পরে, /স্টেনগানের সমন্বিত গর্জনের পরে চিৎকারের পরে...” রাস্তায় পরে থাকেহাড্ডিসার কয়েকজন যুবকের লাশ ...” পাঠকের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, লাশগুলো হেফাজতের তরুণ-সদ্য তরুণহাড্ডিসারকর্মীদের লাশ, যাদের প্রবঞ্চনা করেছে তাদেরবুদ্ধিজীবীরন্যায় ধূর্ত হুজুর-নেতারা, যাদের প্রবঞ্চনা করেছে এই রাষ্ট্র, কখনও রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তনের আশা দেখিয়ে, কখনও ইসলাম-গেলো, ইসলাম-গেলো রব তুলে অথবা নাস্তিক-বধের স্বপ্ন দেখিয়ে। আকতারের কবিতায় এই অপসৃত (Occluded) সত্যগুলো উঠে আসে, কারণ রাষ্ট্রের ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী মুনতাসির মামুনের দৃষ্টিতে হেফাজতের কর্মীরাজঙ্গিযাদের টুটি চেপে ধরাই রাষ্ট্রের একান্ত কর্তব্য (দোহাইঃ http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=16&dd=2013-05-10&ni=134843)       

আকতাররে কবিতাদুটি তাই হয়ে থাকে এক সময়ের নির্মম সাক্ষী, যখন উন্নয়ন-অর্থনীতির চাকা শ্রমিকদের জন্য মায়াকান্নার সার্টিফিকেট প্রদান করে, কিন্তু তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবী নির্মমভাবে দমন করে; যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বাবসায়িরা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির গোঁড়ায় কুঠারাঘাত করতে ব্যাপক উৎসাহী হলেও ধর্মের মন্দিরের আসল বলী মাদ্রাসার হত-দরিদ্র ছাত্রের জীবনমান উন্নয়নে কোন পদক্ষেপের কথা বেমালুম ভুলে যানআপনাদের বলছিআরলাশহয়ে থাকে একুশ শতকের বাংলাদেশের শতকোটি দরিদ্রের না বলা আখ্যান যারা বলি হয় উন্নয়নের বেদীতে ধর্মকে/ধর্মান্ধতাকে সাক্ষী রেখে।