Saturday, May 11, 2013

জাহিদ আকতারের “আপনাদের বলছি” ও “লাশ”ঃ অস্থির সময়ের প্রতিচ্ছবি


জাহিদ আকতারের সাথে পরিচয় বছর দুয়েকের ওনাকে কমিটেড একাডেমিক  প্রবলভাবে রাজনীতি সচেতন মানুষ হিসেবেই জানতাম। তিনি যে কবিতাও লেখেন, অত্যন্ত শক্ত ধাঁচের কবিতা,  জানতাম না। তিনি লেখেন, লিখছেন, ফেসবুকে আমাদের মাঝে অকাতরে বিলিয়ে বেড়াচ্ছেন।গণমানুষের প্রতি শাসক শ্রেণী তাদের চ্যালা চামুণ্ডাদের অবিচারের প্রতি তীব্র অনাস্থা জ্ঞাপন করে লেখা কবিতাগুলো আমাদের চারপাশে খেটে খাওয়া মানুষের উপর উন্নয়নকামী সমাজের ভায়োলেন্সের কথা মনে করিয়ে দেয়।  কবিদের প্লাতো তার উন্নয়নের রূপকল্প শহর-রাষ্ট্র থেকে বিতারনের প্রস্তাব করেছিলেন বহু বছর আগে, সত্যি কবিরাশাইনিং গ্রীক-শহরঅথবাশাইনিং ঢাকাধারণাগুলো কে পরিপূর্ণ রূপ দেয়ার পথে বড় বাঁধা ক্রীতদাস শ্রমিক, উভয়েই উন্নয়নমুখী অর্থনীতির অত্যাবশ্যকীয় উপাদান, কিন্তু মোটেও উন্নয়ন অংশীদার নয়। কবিরা এই রাষ্ট্রীয় প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, প্লাতোর কাছে কবিরা তাই অগ্রহণযোগ্য, উচ্ছিষ্ট ২১ শতকের ঢাকায় উন্নয়ন অর্থনীতির চাকা বেশ জোরসে সচল তাই জাহিদ আকতারের কবিতা রাষ্ট্রের কর্নাধারদের কাছে উপাঙ্গতেয়, বিরক্তি উদ্রেককারীও বটে কারণ এতে শ্রমিকের কথা থাকে, বখতিয়ার আহমেদের ভাষায় বলতে গেলেকাঠামোগত গণহত্যারবিরুদ্ধে দ্রোহ থাকে (দোহাইঃ   http://www.unmochon.com/2012/11/25/39822.html#.UY3do7XP3rw) 

ফেসবুকে প্রকাশিত কবিতাগুলোতে কপিরাইটের বিশেষ ঝামেলা নেই বিধায় অনেকটা সাহস করেই কবিতাগুলো ব্যাবচ্ছেদ করে ফেললাম, কারণ মনে হল জরুরী, অতি জরুরী, না বলা কথাগুলো আকতার তার কবিতায় অকপটে বলে ফেলেছেন। ফেসবুকের বড় ভোক্তা উচ্চ মধ্যবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণির কথাগুলো জানা বেশ জরুরী, কারণ তাতে অল্প হলেও ওপরের-তলায় মারিও-স্টাইলের লাথি লাগার সুযোগ আছে। লাথি মারতেই হবে, নাইলে সুন্দরবন বাঁচবে না, বাঁচবে না শাল-গজারের বনভূমি, আরও বাঁচবে না এদেশের মানুষ যাদের জিম্মি করে চালানো হচ্ছে উন্নয়নের ষ্টীম-রোলার।   
               
আপনাদের বলছিকবিতাটির কথাই ধরা যাক আকতার তুলে ধরেন উন্নয়ন প্রত্যাশী বেনিয়াদের দম্ভ, তাদের অশ্লীল দাবীর খতিয়ানঃ

           “আপনারা আবার সেই পুরনো ক্লিশে কিছু কথা বলছিলেন
            অনুযোগের সুরে বলছিলেন বউ ছল শাক-কচু খাইবার পায় না।'
           একবিংশ শতাব্দীতে এসে আপনারা আবার তেতাল্লিশের কথা বলছিলেন
           চুয়াত্তরের কথা বলছিলেন
           আপনারা আবার সেই পুরনো কথা বলছিলেন
           আপনাদের লজ্জা করা উচিত"   

এইআপনারাহল মেহনতি মানুষ, যাদের সামান্য দাবী (“আপনারা কষ্টের কথা বলছিলেন/না খেয়ে থাকার কথা বলছিলেন”) রাষ্ট্র ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেঃ

                 “আপনাদের বিশ্বাসকে, আপনাদের দর্শনকে, আপনাদের আশাবাদকে
                  আমরা নাড়িভুড়িসমেত প্রত্যাখান করি"

রাষ্ট্রের এইনারিভুরিসমেত প্রত্যাখ্যানসর্বক্ষেত্রে দৃশ্যমান বিত্তবান, বেনিয়া, আধিপত্যবাদী শ্রেণিটি কোন দাবী, বিত্ত আহরণের পথে কোন নড়চড়কে আস্কারা দেয় না, ক্ষমতা প্রদর্শন করে প্রত্যাখ্যান করে গরীবের ন্যায্য পাওনা, তাদের এইনারিভুরিসমেতডিনাইয়াল রূপকার্থে গরিবের ভূখা নাড়িভুঁড়ির চিহ্ন বহন করে।  কবিতাটিতেকাঠামোগত গণহত্যারএকটি আলামত আমরা পাই, কবিতার বয়ানকারী শাসকশ্রেণীর প্রতিনিধিটি হঠাৎ করে ভিতরের ঘৃণাটিনাড়িভুঁড়িসমেতউগড়ে দেয়ঃ   

                 “কত মাস, কত বছর, কত সহস্রাব্দ ভালো থাকলে 
                      তাকে আপনারা ভালো থাকা বলবেন?
                      আর কতবার এ্যাকই কথা বলে আপনারা 
                      মরে যাবেন, পচে যাবেন, গলে যাবেন, 
                      তবু নির্লজ্জের মত আবার জন্মাবেন? 

আমাদের সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের চিত্রকল্প আকতারের এই লাইনগুলোতে পাওয়া যায় গার্মেন্টস ধ্বসে ১০০০ মৃত্যুর পর কয়েকদিন কুমিরের অশ্রুপাত চলে, তারপরই শুরু হয় শিল্প (পক্ষান্তরে মৃত্যুকূপ) বাঁচানোর তথ্য উপাত্ত ভিত্তিক বয়ান। বয়ানের ভাষাবিজ্ঞানঅর্থনীতিরমাপকাঠি মেনে চলে, সেখানে থাকে মৃদু হুমকি, ‘ব্যাটা চাষা-ভূষার দল, কাজ না করলে খাবি ক্যামনেকিন্তু সামান্যতম প্রতিবাদ হলেই শুরু হয়নারিভুরিশমেতআক্রমণ, উন্নয়ন-অর্থনীতির ভাষা বুঝিস না, ব্যাটা অর্ধ-শিক্ষিত, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স, নিদেনপক্ষে দেশের আই.বি./ এন এস ইউ থেকে বাবসা-প্রশাসনে একটা ডিগ্রী নিয়ে আয়, তারপর কাব্যগিরি ফলাস। আকতার সরাসরি কথাগুলো বলেন না, কিন্তু পাঠকের বুজতে অসুবিধা হয় না, “আপনাদের বলছি কবিতার বয়ানকারী চিবিয়ে- চিবিয়ে এই কথাটি বলেন অথবা বলতে চান তবে আগে ভাগেসিরাজগঞ্জের সিমলা গ্রামের বাস কন্ডাক্টর আবু তালেব,/ খুলনার পাইকগাছার দিনমজুর রণজিৎ সাহা,/ সাভারের গার্মেন্টস শ্রমিক মরিয়ম বেগমকে পেয়ে তাদের উপরই সব রাগ ঝাড়েন        
                   
লাশ কবিতাটি বর্তমান সময়ে চলে আসা গণহত্যা প্রতি-গণহত্যা ডিসকোর্সের গালে একটি চপেটাঘাত। কবিতাটিতে প্রাসঙ্গিক ভাবেই কিছু প্রশ্নের উত্তর চাওয়া হয়েছে, অনেকটা সরল, অকপটভাবে। মনে হতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকার লেখক কুদজিয়ার সেই বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী চরিত্রটি (মাইকেল কে) যেন আকতারের কবিতায় প্রবলভাবে উপস্থিত হয়েছে, প্রশ্নবাণে আমাদের বিবেককে নাজেহাল করছে। প্রশ্নগুলো আবার অবান্তরও, কারণ উত্তর আমাদের জানা আছে। তবুও প্রশ্নগুলো কেমন যেন উপেক্ষার নয়, গলার কাঁটার মত বেঁধে থাকে পাঠকের বিবেকের দেয়ালে। আকতার প্রশ্ন তোলেনঃ

          “রাস্তায় কেউ কোনোদিন প্রধান সেনাপতির লাশ দ্যাখেনি
          যেমন দ্যাখেনি কেউ কোনোদিন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের লাশ
          রাস্তায় কেউ কোনোদিন মাল্টিন্যাশনালের প্রধান নির্বাহীর লাশ দ্যাখেনি 
          যেমন দ্যাখেনি কেউ কোনোদিন কোট টাই পরা শিল্পপতির কেতাদুরস্ত লাশ। 
          কেউ কোনোদিন দ্যাখেনি গায়ে পারফিউম মাখা মন্ত্রীর প্রটোকলের লাশ ...
          রাস্তায় কেউ কোনোদিন আমৃত্যু সংগ্রাম চালানোর আহ্বান জানানো 
          জননেতার লাশ দ্যাখেনি, যেমন দ্যাখেনি কেউ কোনোদিন একুশে পদক 
          পাওয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারন করা ঔপন্যাসিকের লাশ। রাস্তায় কেউ 
          কোনোদিন ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপকের হিসেবি লাশ দ্যাখেনি যেমন দ্যাখেনি 
          কেউ কোনোদিন বুদ্ধিজীবীর চশমা পরা বিদগ্ধ লাশ। কেউ কোনোদিন 
          দ্যাখেনি সুশীল সমাজের টেরিকাটা চুলের সুবিন্যস্ত লাশ পড়ে আছে রাস্তায়"

আকতারের কবিতায় প্রধান সেনাপতি, ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক, মাল্টিন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারন করা ঔপন্যাসিক, বুদ্ধিজীবী একাকার হয়ে যান সমাজেকো-অপশনব্যাধি যে কত মারাত্মক আকার ধারণ করেছে তার প্রকৃষ্ট উদাহারন হয়ে থাকে কবিতাটি একে অন্যকে শোষণ শাসনে সহায়তাকারী গোষ্ঠীগুলো কখনোই লাশ হয়না, লাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাইতোঅবিরাম গুলি বর্ষণের পরে, /স্টেনগানের সমন্বিত গর্জনের পরে চিৎকারের পরে...” রাস্তায় পরে থাকেহাড্ডিসার কয়েকজন যুবকের লাশ ...” পাঠকের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, লাশগুলো হেফাজতের তরুণ-সদ্য তরুণহাড্ডিসারকর্মীদের লাশ, যাদের প্রবঞ্চনা করেছে তাদেরবুদ্ধিজীবীরন্যায় ধূর্ত হুজুর-নেতারা, যাদের প্রবঞ্চনা করেছে এই রাষ্ট্র, কখনও রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তনের আশা দেখিয়ে, কখনও ইসলাম-গেলো, ইসলাম-গেলো রব তুলে অথবা নাস্তিক-বধের স্বপ্ন দেখিয়ে। আকতারের কবিতায় এই অপসৃত (Occluded) সত্যগুলো উঠে আসে, কারণ রাষ্ট্রের ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী মুনতাসির মামুনের দৃষ্টিতে হেফাজতের কর্মীরাজঙ্গিযাদের টুটি চেপে ধরাই রাষ্ট্রের একান্ত কর্তব্য (দোহাইঃ http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=16&dd=2013-05-10&ni=134843)       

আকতাররে কবিতাদুটি তাই হয়ে থাকে এক সময়ের নির্মম সাক্ষী, যখন উন্নয়ন-অর্থনীতির চাকা শ্রমিকদের জন্য মায়াকান্নার সার্টিফিকেট প্রদান করে, কিন্তু তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবী নির্মমভাবে দমন করে; যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বাবসায়িরা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির গোঁড়ায় কুঠারাঘাত করতে ব্যাপক উৎসাহী হলেও ধর্মের মন্দিরের আসল বলী মাদ্রাসার হত-দরিদ্র ছাত্রের জীবনমান উন্নয়নে কোন পদক্ষেপের কথা বেমালুম ভুলে যানআপনাদের বলছিআরলাশহয়ে থাকে একুশ শতকের বাংলাদেশের শতকোটি দরিদ্রের না বলা আখ্যান যারা বলি হয় উন্নয়নের বেদীতে ধর্মকে/ধর্মান্ধতাকে সাক্ষী রেখে।