গৌতম ঘোষ পরিচালিত শূন্য অঙ্ক (২০১৩) ছায়াছবিটিতে আধুনিক নাগরিক সমাজের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বকে মধ্যবিত্তসুলভ “ফিল গুড” পিঠ চাপড়ানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখার একটা চেষ্টা করা হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে গৌতম ঘোষ ইতিহাস পর্যালোচনা আর সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ দেখা নাগরিক সমস্যার নতুন বয়ান দর্শকের সামনে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। আমরা মনের মানুষ (২০১০) আর কালবেলার (২০০৯) কথা উল্লেখ করতে পারি। নতুন বয়ান উপস্থিত করার যে প্রচেষ্টা ছবির পরিচালক হিসেবে ঘোষ করেছেন, মনের মানুষ আর কালবেলা কোথাও তার প্রতিফলন দেখা যায় না। মনের মানুষে লালনকে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে ঠাকুর পরিবারের ফ্রেম দিয়ে, লালন কথা বলেন যেভাবে লিবারেল উচ্চ-মধ্যবিত্ত ডিসকোর্সের কাঠামোতে তার বয়ানকে উপস্থাপনের চেষ্টা চলছে। ঐতিহাসিক লালনকে মধ্যবিত্ত দর্শকের সামনে উপস্থাপনই যেন মুখ্য উদ্দেশ্য। কালবেলায় সমরেশ মজুমদারের বয়ানই ঘোষের বয়ান হয়ে উঠেছে। পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিক সমস্যাকে দর্শকের চোখে যেন মধ্যবিত্তের ফ্রেমে কিংবা ছাঁচে ফেলে দেবার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়- বামদের অথবা তাদের ক্ষমতার রাজনীতি সামনে তুলে ধরছেন গৌতম ঘোষ। নতুন বয়ান উপস্থিত করার চেষ্টা শূন্য অঙ্কেও আছে কিন্তু একই সাথে কায়েমি-সাম্রাজ্যবাদী একটি দৃষ্টিকোণ সামনে চলে আসে ঘোষের ছায়াছবিতে।
শুন্য অঙ্ক সাম্প্রতিক সময়ের দুটো অভিঘাত সৃষ্টিকারী, অন্তত দক্ষিন এশিয়ার প্রসঙ্গে অথবা কনটেক্সটে তো বটেই, রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে তৈরি। বলা যেতে পারে পরিচালক গৌতম ঘোষ ব্যাপারগুলোকে সমস্যা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে গৌতম ঘোষ ভারতের বাম-প্রগতিশীল, অপেক্ষাকৃত সচ্ছল, এবং মোটা দাগে প্রতিক্রিয়াশীল নয়, এমন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রিপ্রেজেনটাটিভ হিসেবে হাজির হন। “সমস্যা” দুটি হলো আদিবাসী আন্দোলনে মাওবাদের প্রভাব আর ভারতীয় মুসলিমের আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্ব।
এই প্রসঙ্গে মহুয়া সরকারের “কমিউনিটি অ্যান্ড নেশনঃ গ্রোপিং ফর অলটারনেটিভ ন্যারাটিভ” রচনাটি বিশেষ প্রাসঙ্গিক। অপর্ণা সেন পরিচালিত মিঃ অ্যান্ড মিসেস আয়ার ছায়াছবির নিয়ে লিখিত বিশ্লেষণগুলোর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন,
It is . . . worth noting the ease with
which most of the commentaries on the film identify Meenakshi Iyer’s dilemma as
‘every Indian’s dilemma’, even though the bus was full of characters-all
Indians-with dilemmas that were per force quite different from hers. Why do the dilemmas of the Muslim
couple (to lie about their names or not), or that of Raja (whether to pass as a
Hindu man or not), or that of the intruders, for that matter (to kill or not)
not constitute every Indian’s dilemma? From what subject location is it
possible to assume that the only relevant choices confronting ‘true Indians’
today are that of either ‘protecting’ others or, presumably, being silent? Or,
conversely, what enables us to imagine that ‘true Indians’ are those who face
the specific set of rather privileged dilemmas that an upper caste middle class
Hindu person might face in India today? (5336)
অধিকাংশ বিশ্লেষক মীনাক্ষী আয়ারের দ্বন্দ্বকে “সর্বভারতীয়” দ্বন্দ্ব হিসেবে উপস্থাপন করারা চেষ্টা করেন, যদিও বাসে সকল ভারতীয়র উপস্থিতি ছিল, যাদের দ্বন্দ্বগুলো ভিন্ন। কেন মুসলমান দম্পতিটির (নাম নিয়ে তারা মিথ্যা বলবেন কিনা?) অথবা রাজা চরিত্রটির (হিন্দু হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করবেন কিনা) অথবা হিন্দু জঙ্গিদের (তারা হত্যাকাণ্ড চালাবে কিনা) বৈচিত্র্যময় দ্বন্দ্বগুলোকে “সর্বভারতীয়” দ্বন্দ্ব বলা হচ্ছে না? কোন subject location থেকে এই ধারণা পোষণ করা যায় যে “সত্যিকারের ভারতীয়” মানে হল “আদার”কে রক্ষা অথবা চুপচাপ থাকা? অথবা, একটু ঘুরিয়ে বলতে গেলে, “সত্যিকারের ভারতীয়” দ্বন্দ্ব হলো সমসাময়িক ভারতে উচ্চশ্রেণীর হিন্দু মধ্যবিত্ত দ্বন্দ্ব? (৫৩৩৬)
অপর্ণা সেন পরিচালিত মিঃ অ্যান্ড মিসেস আয়ার চলচিত্রটির উপর লেখা বিশ্লেষণগুলো নিয়ে মহুয়া সরকারের পঠনটি শুন্য অঙ্ক চলচিত্রে উপস্থিত “সত্যিকারের ভারতীয়”র গল্পটি বুঝতে আমাদের সাহায্য করবে। সেনের চলচিত্রে যেমন নব্য উদারবাদী, মধ্যবিত্ত এথিক্সের ধারক মীনাক্ষী আয়ারের দেবীরূপ বিভিন্ন বিশ্লেষণে সরকার খুঁজে পাচ্ছেন, তেমন ভাল মুসলিমের (Good
Muslim) একটি চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত কবির চৌধুরী চরিত্রটির মধ্যে। মহুয়া সরকার যে “সত্যিকারের ভারতীয়”র ভক্তি গদগদ চিত্রকল্পের কথা বলেন, সেই “সত্যিকারের ভারতীয়” এবং একইসাথে মুসলমান হবার প্রাণান্ত চেষ্টা চালান কবির চৌধুরী চরিত্রটি।
অগ্নি আর ঝিলিক দম্পতি সফলতম তরুণ বাঙালী প্রজন্মের পরিচয় বহন করে গৌতম ঘোষের চলচিত্রে। শহুরে, কসমোপলিটান, সেকুলার এই দম্পতি মানালিতে অবকাশ যাপনে গেলে চৌধুরী দম্পতির গৃহে অতিথি হয়ে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। তাদের সমস্যাগুলো একান্তই শহুরে-কর্পোরেট জীবনের ক্লান্তি আর তুনু-তুনু প্রেমের অনুপস্থিতি। অবশ্য এর সাথে যুক্ত হয় অগ্নির “মানব হিতৈষী” সিদ্ধান্ত, আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে উন্নয়নমুখী প্রকল্প স্থাপনের ত্বরিত পরিকল্পনা মুলতুবি রাখা। অগ্নি “সর্ব ভারতীয়” জীবনে উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে, দেখতে চান, এমনি সজ্জন নব্য উদারবাদী, মধ্যবিত্ত এথিক্সের ধারক তিনি, অনেকটা মীনাক্ষী আয়ারের মতো।
উন্নয়নের মন্ত্র থেকে তাকে সাময়িক বিরত রাখেন রাকা বিশ্বাস, তরুণ সাংবাদিক আর “সত্যিকারের ভারতীয়” দেবীরূপী আধুনিকা। কাকতালীয়ভাবে অপর্ণা সেন কন্যা কঙ্কনা সেন, যিনি মীনাক্ষী আয়ার চরিত্রেও অভিনয় করেছেন, রাকা বিশ্বাস চরিত্রটিতে সেই ভালো, এথিক্যাল, মধ্যবিত্ত ভারতীয় নারীর বয়ান উপস্থাপনে চমৎকার অভিনয় করেছেন। অগ্নিকে তিনি বুঝাতে সক্ষম হন, আদিবাসীরা এখনো “সত্যিকার ভারতীয়” হয়ে উঠতে পারেনি, উত্তর-ঔপনিবেশিক, উন্নয়নকামী ভারতে আজ তারা বড়জোর noble
savage। সভ্যতার উৎকর্ষের অর্থ যদি তাদের বুঝাতেই হয়, তবে “সত্যিকার ভারতীয়” মধ্যবিত্ত, লিবারেল এথিক্সের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত উপস্থাপন জরুরী। মহুয়া সরকারের ভাষায়, অগ্নির গভীর বিশ্বাস থাকতে হবে, “ভারতীয় বদান্যতার” ট্রাডিশনে(“[t]he
unwavering belief in the essential benevolence of Indianness . . .,” pg. 5336) যদি কিনা সে উন্নত ভারতের রেলপথে আদিবাসীদেরও দেখতে চায়।
মুসলমান চরিত্র কবির চৌধুরী কিন্তু সেই রেলপথ ধরে বহুপথ ইতিমধ্যে হেঁটে ফেলেছেন। কবির চৌধুরী নামটিও বেশ কাকতালীয় বটে, আমরা বাংলাদেশের সেকুলারপন্থী বুদ্ধিজীবী কবির চৌধুরীর কথা এইখানে উল্লেখ করতে পারি, বাংলাদেশের ইসলামী মৌলবাদীরা যাকে নাস্তিক, কাফের বলে চিত্রিত করেছে এবং আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছে। মিঃ অ্যান্ড মিসেস আয়ার (২০০২) চলচিত্রটির সাথে শূন্য অঙ্কের (২০১৩) এইখানেই প্রবল সাদৃশ্য। ভাল মুসলিম রাজা যেমন আহমেদ বা মুহম্মাদ নন, কবির চৌধুরীও তেমনি মুহম্মদ বা আহমেদ কোন কিছুতেই বশ মানেননি। বরং অগ্নি আর ঝিলিক দম্পতিকে এক পর্যায়ে তিনি জিজ্ঞেস করে বসেন, “What
is your poison” (“মদ্যপানে তোমরা আগ্রহী কিনা?”)। অগ্নি-ঝিলিক তাতে বেশ খুশী হন, ভাবখানা যেন যাক বাবা মৌলবাদী কিংবা খারাপ মুসলিমের হাতে এসে পরিনি আমরা, অথবা বেশ তো গুড মুসলিমের সন্ধান পাওয়া গেলো।
অপর্ণা সেনের রাজা চরিত্র নিয়ে যেমন একধরণের লিবারেল আদিখ্যেতার সন্ধান মহুয়া সরকার আমাদের দিয়েছেন (“. . .
Raja is the modern subject par excellence. He is well travelled, cosmopolitan,
and sees the world- including the violence inflicted on other Muslims marked by
their adherence to religious beliefs and practices- through the panoptical eye
of the camera,” pg. 5337) কবির চৌধুরী, যিনি পেশাগত জীবনে অধ্যাপক ছিলেন, সেইরকম অতিমানবীয় আদিখ্যেতা প্রদর্শন করেন চলচ্ছিত্রটি জুড়ে। তিনি বলেন রবীন্দ্রনাথ আর লালনে তার প্রচণ্ড বিশ্বাস, আবার দারা-শিকোকে ভাল ভারতীয় মুসলিম হিসেবে তিনি শ্রদ্ধা করেন। মহুয়া চৌধুরীর ভাষায় বলতে গেলে, রবীন্দ্রনাথ, লালন, দারা-শিকো সবাই হলেন “সত্যিকার ভারতীয়,” তারাই যেন উচ্চ-মধ্যবিত্ত, লিবারেল এথিক্সের জন্ম দিয়ে গেছেন আর ভারতীয় সভ্যতার মশাল বহন করে চলেছেন। কবির চৌধুরী সেই মশালের নাগাল পেতে হন্যে হয়ে আছেন, কারণ তিনি মদ্যপানকারী, ভারতের অখণ্ডতায় বিশ্বাসী ভাল মুসলিম।
কবির চৌধুরীর সহধর্মিণী কিন্তু সেইভাবে গুড মুসলিম হয়ে উঠতে পারেননি, অন্তত অগ্নি আর ঝিলিকের চোখে। তিনি পরহেজগার নারী। চলচিত্র যতই এগিয়ে যায়, দর্শক জানতে পারেন তিনি মানসিক রোগাক্রান্ত। বিজ্ঞানী-অধ্যাপক চৌধুরীর বয়ানে আমরা জানতে পারি, পুত্রশোকে মিসেস চৌধুরী ধর্মাশ্রয়ী হয়ে পরেছেন। কাশ্মীরে তাদের পুত্র দারাকে হত্যা করেছে ভারতীয় বাহিনী। তাই একদা গুড মুসলিম আর “সত্যিকারের ভারতীয়” মিসেস চৌধুরী ঝিলিককে বলেন, তিনি হিন্দুদের অবিশ্বাস করেন আর হিন্দু-মুসলিম ভাত্রিত্ব অসম্ভব বিষয়। অর্থাৎ খারাপ মুসলিম ভারতের মহানুভবটায় বিশ্বাস করে না, আর সে ভারতীয় কম্পোজিট কালচারের বিরোধী। এইখানে পরিচালক গৌতম ঘোষ কম্পোজিট কালচারের ধারণাটিকে ভারতীয় প্রচারের প্রচ্ছন্ন চেষ্টা চালান।
মহুয়া সরকার যেমন বলেছেন, লিবারেল ডিসকোর্সের আধিপত্যবাদী চরিত্রটি যে কোন আন্দোলন, যে কোন সংগ্রামের ফসলকে co-opt করতে খুব পারদর্শী, গৌতম ঘোষের ডিসকোর্সে “সত্যিকারের ভারতীয়” তত্ত্ব আর অসাম্প্রদায়িকতা একাকার হয়ে গেছে। একে সেকুলার সাম্প্রদায়িকতা বললে মোটেও অন্যায় হয় না। মহুয়া সরকারের বয়ানে, লিবারেল এই ডিসকোর্স বলতে চায়, “সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের উচিত মুসলমানদের সন্নিকটে নিজেকে ‘ভালো’ করে উপস্থাপন করা যাতে তারা ‘পশ্চাৎপদ’ ধর্মাচরণ পরিত্যাগ করে সকলের কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠেন” (“. . .
Hindus should learn to temper their conservatism and open their hearts to
‘others,’ who meanwhile do all the work in losing their ‘backward’ religious
habits so that they will not be a nuisance to anyone . . .” pg. 5337)। শুন্য অঙ্কে ঝিলিক সেই দায়িত্ব নেন। তিনি মিসেস চৌধুরীর ‘খারাপ মুসলিম’ সত্তাকে বিচূর্ণ করতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন এই বলে যে তিনি সকল
হিন্দুকেই ঘৃণা করেন কিনা। রবীন্দ্রসঙ্গীতের মূর্ছনায় মিসেস চৌধুরীকে বশ মানিয়ে ভাল মুসলমানে পরিণত করেন পরিচালক গৌতম ঘোষ। ইতিমধ্যে “সত্যিকারের ভারতীয়” দেবীরূপী আধুনিকা রাকা বিশ্বাসের মৃত্যু ততক্ষণে বশ মানিয়ে ফেলে জংলি আদিবাসীদেরও। শূনো অঙ্কের শেষ অঙ্কটি সেইটা না দেখালেও আমরা কল্পনা করে নিতে পারি বাংলাদেশের কর্পোরেটদের মধ্যবিত্ত বশ-মানানো প্রচারযন্ত্র প্রথম আলোর মতো গৌতম ঘোষের বার্তাটিও হলো, “বদলে যাও, বদলে দাও”।
শরণঃ
শূন্য অঙ্কঃ অ্যাক্ট জিরো. পরিচালক. ঘোষ, গৌতম. সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ধ্রিতিমান চ্যাটারজি আর কঙ্কনা সেন অভিনীত। ২০১৩। ফিল্ম।
সরকার, মহুয়া. “কমিউনিটি অ্যান্ড নেশনঃ গ্রোপিং ফর অলটারনেটিভ ন্যারাটিভ.” ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইক্লি, ভলিউম ৩৮। পৃষ্ঠা ৫৩৩৫-৫৩৩৭।